।। আলোক সরকার ঘুমোতে
গেলেন ২০১৬ খৃস্টাব্দের নভেম্বর মাসে। লিওনার্দ কোহেনের মৃত্যুর
কয়েকদিন পরেই, ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণের কয়েকদিন আগে। শীত যখন পড়েনি। কৃষ্ণচূড়া,
রাধাচূড়া, জারুল যখন ঘুমোতে চাইছে। বাতাসে যখন একরকমের ঝাঁঝালো দারিদ্র্য লেগে গেছে।
নিষ্পত্র গাছগুলো গরমের হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া আর ঠান্ডার নিশ্চিত আসন্নতার মধ্যে
অবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের দিগন্তে হলুদ হয়ে আছে ভারি ধানক্ষেত। কলকাতায়
চেপে বসেছে জমাট ধোঁয়াশা আর নাক-কান-গলার সমস্যাগুলো। এই ঋতু বরিশাল থেকে কলকাতা
অবধিই জীবনানন্দ দাশের। জীবনানন্দ দাশ নামক কবিটি আলোক সরকারের পছন্দের তালিকায়
ছিলেন না। কিছু কবি এবং পাঠকের মধ্যে জীবনানন্দকে নিয়ে যে আদিখ্যেতা দেখা যায়,
আলোক সরকার তা পছন্দ করতেন না। সবাই যেটা নিয়ে মাতামাতি করে আলোক সরকার তার বাইরে
পালাতে চাইতেন, তার বিরুদ্ধে কথা বলতেন। কবিতা, সঙ্গীত, লোকনীতি, আন্তর্জাতিকতা,
সামাজিক সংযোগ... সর্বত্রই আজ আভিজাত্যের অভাব, দৃঢ় অবস্থানের খামতি। একজনের লেখা
আরেকজন যখন লিখে ফেলছে, শুধু নাম দেখে বুঝে নিতে হচ্ছে কোনটা কার লেখা, আলোক সরকার
চলে গেলেন। ১৯৫০ পরবর্তী শ্রেষ্ঠ আধুনিক
কবি আলোক সরকার চলে গেলেন এই হেমন্তে। যেমন এক বেমানান ডাইনোসর রাজকীয় প্রসন্ন ভঙ্গীতে
একদিন লুটিয়ে পড়ে মাটিতে, আর চলে যায় পৃথিবী থেকে, তার জীবাশ্ম ও ডিম ফেলে রেখে।
এই ২০১৬-এ আলোক সরকারকে আর মানাচ্ছিল না। আলোক সরকারের কবিতায় অন্ধকারের মূল্য
আলোর চেয়ে কম নয়। অনুপস্থিতি সেখানে হাজিরা দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি স্থান জুড়ে
থাকে। এই হেমন্তে চলে যাওয়াই তাঁকে মানায়। আলোক সরকারের রৌদ্রময় অনুপস্থিতি আমরা
হয়ত আরো ভালো করে অনুভব করতে পারব। একজন কবি মৃত্যুর পরে তাঁর অনেক প্রাপ্য বুঝে
নিতে পারেন। বিশেষ করে একজন আজীবন অফুরন্ত থেকে যাওয়া কবি। এবার রসিক তৃষ্ণার্ত
পাঠকের সঙ্গে আলোক সরকারের কবিতার আলোকিত সমন্বয়ের পালাটি শুরু হবে। এবার উঠে আসবে
অমরত্বের প্রশ্ন। কবির থাকা আর না-থাকার অভেদ এবার সূচিত হবে, আশা করা চলে।।